বর্তমান সময়ে জমির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অনেকেরই স্বপ্ন থাকে নিজের একটি জমি কেনার। তবে জমি কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক না হলে এটি হতে পারে সারা জীবনের আফসোসের কারণ। বিভিন্ন প্রতারক চক্র সুযোগ নেয় মানুষের এই আবেগের এবং বিক্রির নামে ঝামেলাপূর্ণ জমি হস্তান্তর করে। তাই, জমি কেনার আগে সঠিক যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এমন ৯ ধরণের জমির তালিকা দেওয়া হলো, যেগুলো কেনা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত।
একটা ভালো জমি যেমন আপনার সারা জীবনের একটা সম্বল হতে পারে। ঠিক তেমনি, ভুল জমি ক্রয় আপনার সারা জীবনের কান্নার কারণ হতে পারে।
আসুন জেনে নেই, কোন্ জমিগুলো ভুলেও কেনা উচিত নয়-
১. খাস জমিঃ
খাস জমি হলো এমন জমি যা সরাসরি সরকারের মালিকানাধীন এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এই জমি সাধারণত ভূমিহীন ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারীভাবে বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু প্রতারক চক্র জাল দলিল তৈরি করে খাস জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করার চেষ্টা করে। যদি আপনি খাস জমি কিনে থাকেন, তবে এটি আইনি ভাবে অবৈধ এবং আপনি জমির উপর মালিকানা বা দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।
আইনে বলা আছে, কোনো জমি যদি সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে ও সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে সেইগুলোই খাস জমি। সরকার এ জমিগুলো বন্দোবস্ত দিতে পারেন। সাধারণত ভূমিহীন ব্যক্তিরা সরকারীভাবে খাস জমি পায়। এজন্য জমি কিনার পূর্বে ভুমি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখুন যে জমিটি খাস জমি কিনা?
২. অর্পিত সম্পত্তিঃ
অর্পিত সম্পত্তি হলো সেই সমস্ত জমি যা মূলত হিন্দু মালিকরা দেশত্যাগ করার পর সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে যায়। এই সম্পত্তিগুলো “অর্পিত” বা “অনাবাসী সম্পত্তি” (Vested and Non-Resident Property) হিসেবে চিহ্নিত হয়। আইনের নিয়ম অনুযায়ী, এই জমিগুলো বিক্রয়, হস্তান্তর বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি, যতক্ষণ না সরকার এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অনুমোদন দেয়। এসকল জমি সরকার ছাড়া অন্য কেও ক্রয় বিক্রয় করতে পারে না। এজন্য, যেকোন জমি ক্রয়ের আগে খোঁজ নিন এগুলো সরকারের তালিকাভুক্ত অর্পিত জমি কিনা?
৩. অধিগ্রহণকৃত জমি বা এরূপ সম্ভাবনার জমিঃ
রাষ্ট্র বা সরকার দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেমন শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশ পথ বা এ জাতীয় অন্য কিছুর জন্য জনগণের কোন ভূমি যদি দখল করে নেয় তাকে বলে “অধিগ্রহণ”। সরকার দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কারো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে।
অনেকেই সরকারের অধিগ্রহণকৃত জমি প্রতারণা করে বিক্রি করে। এজন্য, জমি ক্রয়ের পূর্বে ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনে নিন জমিটি সরকারের অধিগ্রহণকৃত জমি কিনা বা ভবিষ্যতে অধিগ্রহণ করার সম্ভবনা আছে কিনা?
৪. যাতায়াতের রাস্তা নেই এরূপ জমিঃ
যাতায়াতের রাস্তা নেই এমন জমি ক্রয় করলে সেটি ব্যবহার বা বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যার কারণ হতে পারে। এই ধরনের জমি সাধারণত পরিবহন ও যোগাযোগের অযোগ্য হয়। এর ফলে, জমিতে যাতায়াতের সুযোগ না থাকায় তা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এমন জমি দখল করতেও ভবিষ্যতে অনেক ঝামেলার মুখে পড়তে হতে পারে। যাতায়াতের রাস্তা না থাকা জমি অনেক সময় “অবরুদ্ধ জমি” (Landlocked Property) নামে পরিচিত, যা আইনগতভাবে ব্যবহারের জন্য জটিল হতে পারে।
৫. ইতোমধ্যে অন্যত্র বিক্রয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ কিনাঃ
অনেক প্রতারক বিক্রেতা একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করে থাকে। এতে ক্রেতারা আইনগত মালিকানা পেয়েও জমি ভোগ করতে পারেন না, কারণ জমিটির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। যদি জমিটি পূর্বে অন্য কারো কাছে বিক্রয় করা হয় বা বায়না চুক্তি (Agreement for Sale) সম্পন্ন করা হয়, তাহলে নতুন ক্রেতার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এই ধরনের জমি কেনার ফলে:
- আইনি ঝামেলায় পড়তে হয়।
- জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন মামলা মোকদ্দমা করতে হয়।
- অর্থনৈতিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬. বন্ধকীকৃত জমিঃ
বন্ধকীকৃত জমি হলো এমন জমি যা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের জন্য বন্ধক রাখা হয়েছে। এ ধরনের জমি বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ, কারণ ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত জমির মালিকানার উপর সম্পূর্ণ অধিকার বন্ধকগ্রহীতা (ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান) ধরে রাখে। বন্ধকীকৃত জমি কিনলে:
- আপনি জমির বৈধ মালিকানা পাবেন না।
- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জমিটি জব্দ করতে পারে।
- জমি নিয়ে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।
৭. কোন আদালতে মামলায় আবদ্ধ জমিঃ
যে জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে বা মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে, সে জমি ক্রয় থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জমির প্রকৃত মালিকানা নিশ্চিত করা যায় না। এ ধরনের জমি কিনলে আপনি আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন এবং জমি ব্যবহার বা বিক্রি করতে বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। জমি কেনার আগে রেজিস্ট্রি অফিস ও আদালত থেকে জমির রেকর্ড যাচাই করুন এবং একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তা নিন, যাতে জমির আইনি অবস্থা নিশ্চিত করা যায়। মামলায় আবদ্ধ জমি ভবিষ্যতে আর্থিক ক্ষতি এবং মানসিক চাপের কারণ হতে পারে।
৮. বিরোধপূর্ণ জমিঃ
বিরোধপূর্ণ জমি কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এই জমির মালিকানা নিয়ে সাধারণত ওয়ারিশদের মধ্যে বিরোধ বা বিবাদ থাকে, যা আইনি জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ওয়ারিশ সনদ বা বণ্টননামা প্রস্তুত করা হয় না, ফলে জমি দখল বা ব্যবহার নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। কৃষি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে রেকর্ডীয় মালিকানার অংশীদারগণ অগ্রক্রয়াধিকার (Pre-emptive Right) দাবি করতে পারেন, যা জমি দখলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জমি কেনার আগে সব অংশীদারের লিখিত সম্মতি এবং আইনি নথিপত্র যাচাই করা আবশ্যক। এ ধরনের জমি কেনা মানে ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকি নেওয়া।
৯. দখলহীন জমিঃ
জমি কেনার ক্ষেত্রে দলিল ও দখল দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটির অভাবে জমির মালিকানা সম্পূর্ণ হয় না। যদি বিক্রেতার দখলে জমিটি না থাকে, তবে সেই জমি কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত। দখলহীন জমি ক্রয় করলে ভবিষ্যতে দখল প্রতিষ্ঠার জন্য ঝগড়া, দাঙ্গা বা মামলায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে, যা আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। জমি কেনার আগে বিক্রেতার দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করা অপরিহার্য।
১০. নাবালকের নামে জমিঃ
জমি যদি নাবালকের নামে থাকে, তবে সে জমি আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক ছাড়া বিক্রি করা যায় না। সাধারনত ১৮ বছরের নিচে ব্যক্তিকে নাবালক বলা হয়। এজন্য, অনেকেই এমন জমি কিনে যা ওয়ারিশসূত্রে কোন নাবালকের অংশ আছে। কিন্তু, নাবালক বড় হয়ে মামলা করলে জমিটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এজন্য, এ ধরনের জমি কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক হোন।