ইসলামী বর্ষপঞ্জির অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ মাস হল যিলহজ মাস। এ মাসের প্রথম দশ দিনকে মহান আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় করেছেন। কোরআন-হাদীসের আলোকে এ দিনগুলোতে নেক আমলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত, এ দিনগুলোকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো।
১. তাওবা: ফিরে আসার অঙ্গীকার
তাওবা শব্দের অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ, আল্লাহর নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, অতীতের পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে আর তা না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।
আল্লাহ বলেন:
“‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’”
📖 সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৮
এই দিনগুলোতে তাওবা করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি, যা এই সময়ের অন্যতম বড় নিয়ামত।
২. ফরয ও নফল সালাত আদায়ের গুরুত্ব
ইবাদতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সালাত। ফরয সালাত যথাসময়ে আদায় করা এবং বেশি বেশি নফল সালাত পড়া এ দিনগুলোতে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের উত্তম উপায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরয ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে তাতে কোনো রকম দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার প্রতি কষ্টদায়ক বস্তু দিতে অপছন্দ করি।
সুতরাং, ফরয সালাত সময়মতো আদায় করা ও তাহাজ্জুদ, চাশত, দোহা, এবং সালাতুত-তওবা ইত্যাদি নফল সালাত আদায়ে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. যিলহজের প্রথম দশ দিনের রোজা রাখা
যিলহজের প্রথম দশ দিনের সিয়াম বা রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই দশকে রোজা রাখতেন।
হাদিস:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরা, যিলহজের প্রথম দশক, প্রতি মাসে তিন দিন এবং ফজরের পূর্বে দুই রাকাত সালাত কখনো পরিত্যাগ করতেন না।”
৪. হজ ও ওমরার ফজিলত
যারা সামর্থ্যবান, তাদের জন্য হজ ও ওমরা পালন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।”
৫. যিকির ও আল্লাহর স্মরণ
এই দশ দিনে আল্লাহর প্রশংসা, তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার), ও তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি করে পড়া সুন্নত।
“আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এ দশ দিনে [নেক] আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল [লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ] তাকবীর [আল্লাহু আকবার] তাহমীদ [আল-হামদুলিল্লাহ] বেশি করে আদায় কর।”
৬. তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ উচ্চ আওয়াজে পাঠ
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবীর পাঠ করবে।
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. যিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন
📢 তাকবীর পাঠ:
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, মানুষরাও তাদের দেখে দেখে তাকবীর বলত। তিনি আরও বলেছেন, ইবনে ওমর মিনায় তার তাবুতে তাকবীর বলতেন, মসজিদের লোকেরা শুনত, অতঃপর তারা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর বলত। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
৭. আরাফার দিনের রোজা
৯ যিলহজ—আরাফার দিন, হজ পালন না করা লোকদের জন্য রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন “আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছররে গুনাহর কাফফারা হবে।”
৮. কুরবানির দিন ও আমল (১০ যিলহজ)
১০ যিলহজ বা ঈদুল আজহার দিন কুরবানি করা ইসলামী শরিয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল।
“আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন”
🔹 এ দিন কুরবানির পাশাপাশি ঈদের সালাত, তাকবীর, যিকির ও শুকরিয়া আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ।
যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন প্রতিটি মুসলমানের জন্য আত্মশুদ্ধি ও নেক আমল অর্জনের একটি অপূর্ব সুযোগ। আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের পথ সুগম করে দেয় এই দিনগুলো। তাই আসুন, আমরা এসব দিনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পালন করি—নিয়মিত তাওবা করি, সালাত আদায় করি, রোজা রাখি, যিকির করি, তাকবীর পাঠ করি এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করি।